সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কড়া নজরদারিতে প্রায় তিন বছর বন্ধ থাকলেও ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে সাগরপথে মানব পাচারকারি চক্রের সদস্যরা। বাংলাদেশ থেকে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় ২০১৫ সালে শত শত বাংলাদেশি গ্রেফতার হন। আবার মানব পাচারকারি চক্রের খপ্পড়ে পড়ে মালয়েশিয়াগামী অনেকেই ক্ষুধা আর তৃষ্ণার জ্বালায় সাগরপথেই মারা যান। ফের কক্সবাজারে সক্রিয় মানব পাচারকারী চক্র। চক্রটি সাগরপথে শুরু করেছে মানব পাচার। পাচারের পাশাপাশি দস্যুবৃত্তিতেও জড়িয়ে পড়ছে চক্রের সদস্যরা। যার শিকার হচ্ছে উখিয়া এবং টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন অস্থায়ী ক্যাম্পে ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গারা। পাচারকারীদের কবল থেকে পুরুষের পাশাপাশি নারী আর শিশুরা রক্ষা পাচ্ছে না । মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তাদের পাচারের শিকারের পরিণত করা হচ্ছে। পৃথক অভিযানে এই ধরনের পাচারের শিকার ৪৩ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছে পুলিশ ও র্যাব।
১৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ৩১ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়েছে। যাদের মধ্যে ৬ শিশু আর ১২ জন নারী রয়েছে। তারা কুতুপালং এবং বালুখালী অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা। মহেশখালী উপজেলার সোনাদিয়া দ্বীপের প্যারাবন থেকে তাদের উদ্ধার করা হয়।
উদ্ধারকৃতদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) কক্সবাজার শহরের ফজল মার্কেট সংলগ্ন হোটেল রাজমণিতে এক অভিযান পরিচালনা করে র্যাব-৭। রাত সোয়া ৩ টায় পরিচালিত ওই অভিযানে উদ্ধার করা হয় ১২ রোহিঙ্গাকে। এ সময় দুই পাচারকারীকে আটক করতে সক্ষম হন র্যাব সদস্যরা। আটককৃত দুই পাচারকারী হলো, চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া উপজেলার পশ্চিম মিরিকেল এলাকার মৃত ওমর আলীর পুত্র মোঃ নুরুল ইসলাম ও উখিয়ার থাইংখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ব্লক-বি ২৬ এর বাসিন্দা মোঃ শফিক’র পুত্র জাহেদ আলম।
এদিকে, পাচারের শিকার রোহিঙ্গাদের উদ্ধারের পরপরই বেরিয়ে এসেছে লোমহর্ষক কাহিনী। কিভাবে পাচারকারীরা তাদের ক্যাম্প থেকে গোপন স্থানে নিয়ে আসে। এরপর স্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য করে। নির্যাতনের মাধ্যমে আদায় করে অর্থ। পদে পদে পাচারকারীদের নির্যাতনের এই নির্মম কাহিনী বর্ণনা করেছেন উদ্ধারকৃত কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী।
রোহিঙ্গা নারীদের বর্ণনায় বেরিয়ে এসেছে, শুধু কক্সবাজার জেলার বাসিন্দা নয়। খোদ রোহিঙ্গাদের একটি শক্তিশালী চক্রও রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বেশ সক্রিয়। কক্সবাজার শহরে এই চক্রের অন্যতম সদস্য পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের সমিতি পাড়ার সেলিম এবং সদস্যা লায়লা। মহেশখালীর সোনাদিয়ার শাহীন, এনাম, আনছার, মনুইয়্যা এবং শামশু। তবে, মৃত্যুভয়ে রোহিঙ্গা পাচারকারীদের নাম প্রকাশ করেনি উদ্ধারকৃতরা। পুলিশ এবং কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকির সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিভাবে পাচারকারীরা তাদের কক্সবাজারে নিয়ে এসেছিলো তাও বর্ণনা দিয়েছে এই নারীরা।
ফাতেমা এবং শহীদা দুই সহোদরা। ষোড়শী এই দুই রোহিঙ্গার পিতা কুতুপালং ৪নং আনরেজিস্টার্ড ক্যাম্পের বাসিন্দা শামশুল আলম। বুধবার তাদের সোনাদিয়ার প্যারাবন থেকে উদ্ধার করা হয়। ফাতেমা এবং শহীদা জানিয়েছে, মঙ্গলবার পাচারকারীদের প্রলোভনে তারা ক্যাম্প ত্যাগ করে। ক্যাম্পের চারপাশে ১১ টি নিরাপত্তা চৌকি আছে। এসব চৌকিতে দায়িত্বরতদের চোখ ফাঁকি দিতে তারা প্রথমে হেঁটে ক্যাম্প থেকে বের হয়। এরপর তাদের তুলা হয় একটি গাড়িতে। গাড়িটি কিছুদূর যেতেই তাদের নামিয়ে আবারো হাঁটতে বাধ্য করা হয়। এভাবেই তারা বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পাচারকারীদের সঙ্গে কক্সবাজার শহরে প্রবেশ করে। কক্সবাজার শহরে পৌঁছে তারা সমিতি পাড়ার সেলিমের ঠিক করা বাড়িতে উঠে। ওই সময় বাড়িটিতে আরো বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার দেখা পায় তারা। সেখান থেকেই রাতে ইঞ্জিনচালিত বোটে করে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় সোনাদিয়ায়।
সোনাদিয়ায় পৌঁছার পর তাদের প্যারাবনে আটকে রাখা হয়। কেড়ে নেয়া হয় তাদের কাছে থাকা মোবাইল ফোন। পাশাপাশি তাদের কাছে থাকা নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কারও কেড়ে নেয় পাচারকারীরা। যাদের কাছে কিছু পাওয়া যায়নি তাদের উপর চলে নির্মম নির্যাতন। অনেকেই নির্যাতন সইতে না পেরে পাচারকারীদের মোবাইল ফোনে ক্যাম্পে থাকা স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এরপর বিকাশের মাধ্যমে দাবিকৃত টাকা দেয়ার পর নির্যাতন থেকে রেহাই পায়। প্যারাবনে পৌঁছার পরই তারা শাহীন, এনাম আনছার, মনুইয়্যা আর শামশুর নাম শুনতে পায়। তারা আটককৃতদের উপর নির্যাতন চালায় বলেও জানায় উল্লিখিত দুই সহোদরা।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন বলেন, মানব পাচারকারীদের ধরতে ও মানব পাচার ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবসময় তৎপর রয়েছে। কোস্টগার্ড, বিজিবি, পুলিশ ও র্যাবকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় মানব পাচার ঘটনাও প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে।
প্রসঙ্গত : রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি বাংলাদেশিদেরও টার্গেট করতে পারে মর্মে আশঙ্কা করা হচ্ছে। “মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য ১৪ লাখের অধিক বাংলাদেশি নিবন্ধন করেছিলেন। সেখান থেকে মাত্র কয়েক হাজার মানুষ দেশটিতে যেতে পেরেছেন। বাকিরা সুযোগ পেলে অবৈধ পথেও মালয়েশিয়া যেতে রাজি হবেন। দালালরা সেই সুযোগ নিতে চায়।” সরকারের উচিত মানুষকে সচেতন করা ও বৈধ পথে অধিক হারে কর্মী পাঠানোর ব্যবস্থা করা। কক্সবাজারে সর্বশেষ মানব পাচার আইনে প্রায় ৪০০ মামলা হয়েছে। কিন্তু, মামলাগুলো সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি এবং কোন মামলাতেই চিহ্নিত শীর্ষ পাচারকারীদের আসামী করতে পারেনি পুলিশ।