একের পর এক শীর্ষনেতাদের যুদ্ধকালীন অপরাধ প্রমাণিত হওয়া এবং মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরের পরও জামায়াতে ইসলামী এখনও দায় স্বীকার করছে না। উল্টো এখনও তাদের ওয়েবসাইট, বক্তব্যে এসব অপরাধকে ‘কথিত অপরাধ’ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধকে ‘কথিত’ বলাকেও অপরাধ বলে মনে করছেন আইনজীবীরা। তারা বলছেন, এতে পুরো বিচারপ্রক্রিয়াকেই হেয় করা হয়। প্রসিকিউশন পক্ষ বলছেন, বক্তৃতা বিবৃতি এমনকি নিজের লেখায় যারা নিজেদের কাজকর্মের অসংখ্য প্রমাণ রেখে গেছেন, তাদের মুখে এখন ওইসব কাজকে ‘কথিত’ বলাটা বিচার থেকে বাঁচার পায়তারা ছাড়া কিছু নয়।
নিজামীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৩ আগস্ট চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউটে ইসলামী ছাত্রসংঘ আয়োজিত সভায় নিজামী বলেন, ‘পাকিস্তান আল্লাহর ঘর। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তিনি প্রিয় ভূমির হেফাজত করছেন। দুনিয়ার কোনও শক্তি পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে পারবে না।’ এসব বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ছাত্রসংঘের সদস্য, রাজাকার ও অন্যদের মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের উসকানি ও প্ররোচনা দেন নিজামী।
সবকটা বক্তৃতা বিবৃতি তিনি অস্বীকার করে গেছেন। সেগুলোর ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন আদালতের সামনে।১২ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, ২২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক একাডেমি হলে আল মাদানির স্মরণসভায় নিজামী বলেন, পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে শত্রুরা অস্ত্র হাতে নিয়েছে। তিনি পাকিস্তানের শত্রুদের সমূলে নির্মূল করার আহ্বান জানান।
২২ সেপ্টেম্বর মতিউর রহমান নিজামী কোনও রাখঢাক না করেই সুস্পষ্ট অভিযোগের আঙুল তোলেন বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে। ইসলামিক একাডেমিতে আয়োজিত সিরাত সম্মেলনে গোলাম আযমের উপস্থিতিতে পাকিস্তান ছাত্র সংঘ প্রধান বলেন, যারা ইসলামকে ভালোবাসে, শুধু তারাই পাকিস্তানকে ভালোবাসে। এবারের উদঘাটিত এই সত্যটি যাতে আমাদের রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা ভুলে যেতে না পারেন, সেজন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
১৪ নভেম্বর মতিউর রহমান নিজামীর লেখা ‘পাকিস্তান ও আল বদর’ নামে একটা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় সংগ্রামে। সেখানে নিজামী লেখেন, ‘আমাদের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে। পাকসেনার সহযোগিতায় এ দেশের ইসলামপ্রিয় তরুণ ছাত্র সমাজ বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আলবদর বাহিনী গঠন করেছে। বদর যুদ্ধে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল তিনশত তের। এই স্মৃতিকে অবলম্বন করে ৩১৩ জন যুবকের সমন্বয়ে এক একটি ইউনিট গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বদর যোদ্ধাদের সেইসব গুণাবলীর কথা আমরা আলোচনা করেছি, আলবদর তরুণ মুজাহিদদের মধ্যে ইনশাল্লাহ সেই সব গুণাবলী আমরা দেখতে পাব।’
১৯৯২ সালে এক সাংবাদিক সম্মেলনে একাত্তরের এই ঘাতক, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের হোতা আলবদর বাহিনীর প্রধান নিজামী ১৯৭১ সালে জামায়াতের ভূমিকা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, স্বাধীনতার ২০ বছর পরে রাজনৈতিক স্বার্থে যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক কোনও প্রশ্ন করার অধিকার কারও নেই। আওয়ামী লীগ তাদের সাড়ে তিন বছর শাসনকালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচার করেনি, এমনকি তদন্তও শেষ করেনি কারণ তারাই (আওয়ামী লীগ) বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল।
তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক হান্নান খান বলেন, এ ধরনের ধৃষ্টতার জবাবে একের পর এক অপরাধ প্রমাণ হওয়ার পাশাপাশি তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হচ্ছে। ওদের রাজনৈতিক অবস্থানের কারণেই তারা ‘কথিত’ শব্দটা ব্যবহার করে আসছে। যেটা এখন আর করার অধিকার তারা রাখে না। কেননা, তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের নানা অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে ইতোমধ্যে।
অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পর সেটাকে কথিত হিসেবে উল্লেখ করা আদালত অবমাননার সামিল বলে উল্লেখ করেন প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। একটা বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যখন অপরাধ প্রমাণিত হচ্ছে তখন আর সেটাকে কথিত বলতে পারবে না। একদিকে আদালতের সুযোগ সুবিধা নিচ্ছেন আবার আরেকদিকে আদালত মানছেন না। কথিত বলাটা একেবারেই অবজ্ঞা করে বলারই সামিল। এভাবে বক্তৃতা, বিবৃতি, ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করতে পারে না উল্লেখ করে তুরিন বলেন, এটা একইসঙ্গে সংবিধান অবমাননাও বটে। কেননা ১৯৭৩ সালের আইনকে সংবিধানের ওপরে স্থান দেওয়া হয়েছে সংবিধান অনুসারেই।
গণজাগরণ মঞ্চের ইমরান এইচ সরকার মনে করেন বিষয়টা ট্রাইব্যুনালের নজরে আনা জরুরি। বিচার সম্পন্ন হওয়ার পর, মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জামায়াত ও এর নেতাদের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হওয়ার পর এ ধরনের শব্দ তারা আর রাখতে পারে না। আমরা মনে করি এই সংগঠনের কার্যক্রম চালানোর কোনও অধিকারই নেই। যত দ্রুত সম্ভব এদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিৎ। আমরাও সেই দাবি সামনে এনে দ্রুতই কর্মসূচি ঘোষণা করব।