ঈদের আগে টানা ৩৬ ঘণ্টা গাড়ি চালাতে হয় বাসচালকদের। কখনো কখনো সেটা ৫০-৬০ ঘণ্টা পর্যন্ত ওঠে। এ সময় তাঁদের নাওয়া-খাওয়া নেই, এমনকি ঘুমও। সহকর্মী মশিউল আলমের ‘জীবনের গল্প’ শীর্ষক কলামের এ সপ্তাহের রচনায় এক দূরপাল্লার বাসচালকের জবানিতে এ তথ্য পাওয়া গেল, যেটা আমাদের সবারই কম-বেশি জানা।
ছাত্রজীবনে যখন রাতের বাসে রাজশাহী থেকে ঢাকা আসতাম, তখন দেখতাম, চালকের সহকারী অনবরত চালকের সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছেন। চালক একটু পর পর পানি পান করছেন বা পান খাচ্ছেন। আবার সহকারী যখন কথা বলতেন না, তখন তিনি বাসের দরজায় একটু পরপরই টোকা দিতেন। নৈশ কোচের সামনের আসনের যাত্রীরা এতে কিছুটা বিরক্ত হতেন, ঘুমে ব্যাঘাত ঘটত বলে। কিন্তু চালক-সহকারীর মধ্যে এ আলাপচারিতা না হলে যে কী হতো, তা বলা মুশকিল। কারণ, নৈশ কোচের যাত্রীরা ঘুমাতে পারলেও চালকের ঘুমানোর উপায় নেই, তিনি একটু ঘুমিয়ে পড়লেই সবার জীবন বিপন্ন হতে পারে। আর তাই চালককে জাগিয়ে রাখার জন্য এত আয়োজন।
বাংলাদেশের সব অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের মতো বাসচালকদেরও মজুরিটাই সম্বল। সারা জীবন গাড়ি চালিয়ে অবসরে গেলেও তাঁদের কপালে কিছু জোটে না। কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। ছোট পরিবহন কোম্পানিগুলোর চালকদের অবস্থা তো আরও করুণ। ট্রিপ না মারলে ভাত নেই। আর তাই তাঁরাও জীবনটা হাতে নিয়ে এভাবে রাস্তায় নেমে যান। আর আমরা যারা এই মানুষদের হাতে জীবনটা সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্তে বাসে বসে ঘুম দিই, তারা কখনো এ নিয়ে ভাবিও না।
তাই সড়ক দুর্ঘটনার এটিও একটি কারণ, তা আমরা এ ব্যাপারে যতই চোখ বুজে থাকি না কেন। অথচ বাংলাদেশের বড় পরিবহন কোম্পানিগুলো চাইলে চালকদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে। তারা চালকদের বেতন বাড়িয়ে ও অধিকসংখ্যক চালক নিয়োগ দিয়ে ট্রিপের সংখ্যা কমাতে পারে, এতে চালকদের আয় কমবে না। প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়, কিন্তু আমরা সব দোষ শুধু চালকদের ঘারে চাপিয়েই খালাস। আমি বলছি না যে তাঁদের ত্রুটি নেই। যেমন, এখন ঈদের পর চালকেরা রাস্তা ফাঁকা পেয়ে বেপরোয়া গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছেন (আরও কারণ থাকতে পারে)। গত দুই-তিন দিনে অনেক মানুষই এ কারণে প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু এ দিকটিও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। পরিবহন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ, এ পরিপ্রেক্ষিতে এত এত দুর্ঘটনার দায় কিন্তু তাঁদের ঘাড়েও বর্তায়।