সরকারি তিন সংস্থার সমন্বয়ের অভাবে ৫৪৪ কিলোমিটার দীর্ঘ চট্টগ্রামের চারটি নদী রক্ষায় সরকারের গৃহীত উদ্যোগ আটকে আছে এক বছর ধরে। নদী চারটি হচ্ছে– কর্ণফুলী, হালদা, সাঙ্গু ও ইছামতি। সমন্বয় না থাকা সংস্থা তিনটি হচ্ছে– জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তর ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।
সমন্বয়হীনতার কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, অবৈধ দখল, ভরাট ও দূষণ রোধে নদী চারটির সমগ্রিক তথ্য চেয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে গত বছরের জুন মাসে একটি দাপ্তরিক চিঠি দিয়েছিলেন। তবে গতকাল পর্যন্ত তথ্যগুলো পাঠায় নি পরিবেশ অধিদপ্তর। তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের দাবি, একই বছরের ২৩ জুন জাতীয় নদী কমিশনের চাওয়া তথ্যগুলো সরবরাহ করার জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে তারাও একটি চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু জেলা প্রশাসন তথ্যগুলো সরবরাহ করে নি। এমন পরিস্থিতিতে পরিবেশবাদীরা মনে করছেন, সরকারি উদ্যোগ বাস্তবায়নে যেন সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা ও উদাসিনতায় বড় বাধা।
নদী রক্ষায় সরকারি উদ্যোগে সরকারি সংস্থার সমন্বয়হীনতার মধ্য দিয়ে আজ চট্টগ্রামসহ সারাদেশে পালিত হবে ‘বিশ্ব নদী দিবস’। আমাদের দেশে ২০১০ সাল থেকে রিভারাইন পিপল নামের একটি সংস্থা এ দিবস পালন করে আসছে। তবে ১৯৮০ সাল থেকে প্রতিবছর বিশ্ব নদী দিবস পালন করতে শুরু করে ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি। ২০০৫ সালে জাতিসংঘ দিবসটি অনুসমর্থন করে। এবছরের নদী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় সম্পর্কে হালদা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া দৈনিক আজাদীকে বলেন, প্রকৃতি সুস্থ থাকলে নগর সুস্থ থাকে। নদী হল প্রকৃতির রক্তনালী, পানি হল এর রক্ত। ওই হিসেবে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যে তথ্য পাওয়া যায় নি এক বছরেও : গত বছর জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন থেকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে ছক আকারে চারটি নদীর পৃথক তথ্য চেয়েছিলেন। এর মধ্যে নদী নাব্য কিনা (সর্বশেষ খননের তারিখ), নদী দূষণমুক্ত কিনা, নদীতে অবৈধ দখল/স্থাপনা আছে কিনা, থাকলে স্থাপনার সংখ্যা, নদী তীরে বাজার ও মোট শিল্প কারখানার সংখ্যা কত, নাব্যতা বৃদ্ধিতে নদী খননের কোন প্রস্তাবনা আছে কিনা, দূষণমুক্ত করার জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে কিনা, অবৈধ দখলদার ও স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান করা হয়েছে কিনা– তা জানতে চাওয়া হয়েছিল।
এদিকে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের চিঠির প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তর, বন্দর, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, সহকারি কমিশনার (ভূমি) অফিস আগ্রাবাদ ও সদর সার্কেলকে সংশ্লিস্ট নদীর নিজ নিজ অংশের তথ্য জানানোর জন্য চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু সদর সার্কেল ছাড়া আর কেউ এ সব তথ্য সরবরাহ করেনি।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আতাহারুল ইসলাম গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, প্রায় একবছর আগে চট্টগ্রামের চারটি নদীর তথ্য চেয়ে আমরা পরিবেশ অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু এখনো তথ্যগুলো পাইনি। তাদের সহযোগিতা আমরা পাচ্ছি না। তথ্য না দেয়ার কারণ কি থাকতে পারে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, হয়তো এমনো হতে পারে তাদের অনাগ্রহ রয়েছে। আবার নদীগুলো নিয়ে কিছু করা উচিত সেই ফিলিংসটাই হয়তো তাদের নেই। আবার তাদের জনবল সংকটও থাকতে পারে।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন নদী আপনি সরজমিন পরিদর্শন করেছেন। পরবর্তীতে নদীগুলো সংরক্ষণে নানা নির্দেশনাও ছিল আপনার। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে চট্টগ্রামের নদীগুলো কোন পর্যায়ে আছে বলে মনে করেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, আমি যতটুকু নির্দেশনা দিয়েছিলাম তার আলোকে কোন পরিবর্তন হয়নি। অনেস্টলি বললে, ‘শূন্যের কোটায়’। এখন চট্টগ্রামের নদীগুলোর দূষণের দিক থেকে যদি বলি তাহলে হালদার একটি পার্ট দূষিত। বাকিটা মোটামুটি আছে। যে রাবার ড্যাম হয়েছে তার কারণে হালদার একটি অংশ শুকানো হয়। ওই সময়ও দূষণ বাড়ে। তবে কর্ণফুলীতে দূষণের হারটা বেশি।
চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক বিভাগীয় পরিচালক মকবুল হোসেন দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমি এখন চার্জে নেই। তাছাড়া কোন ধরনের তথ্য চাওয়া হলে তা পাঠানোর কথা। হয়তো এমনো হতে পারে আমাদেরকে আর ‘নক’ করা হয় নি।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক বদরুল হুদা দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমরা জেলা প্রশাসনের কাছে তথ্য চেয়েছিলাম। ওখান থেকে না পাওয়াতে কমিশনের কাছে পাঠাতে পারিনি।
জানতে চাইলে গতকাল শনিবার কর্মস্থলে যোগ দেয়া চট্টগ্রামের নতুন জেলা প্রশাসক মো. শামসুল আরেফিন দৈনিক আজাদীকে বলেন, বিষয়টি আমার নলেজে নেই। বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখব। তবে চট্টগ্রামে যে কয়টি নদী রয়েছে সেগুলো রক্ষায় আমরা সর্বোচ্চভাবে চেষ্টা করবো। নদী কমিশন নদীগুলো রক্ষায় যে সব পরিকল্পনা গ্রহণ করবে সেগুলোও আমরা বাস্তবায়নে জোর দিব। এ সময় জেলা প্রশাসক নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলো রক্ষা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন।
নদীগুলোর বর্তমান অবস্থা : নদী কমিশনের তথ্য মতে চারটি নদীর দৈর্ঘ্য হচ্ছে যথাক্রমে– কর্ণফুলী নদীর দৈর্ঘ্য ১৩১ কিলোমিটার, হালদা নদীর দৈর্ঘ্য ৮৮ কিলোমিটার, ইছামতি নদী ৩০ কিলোমিটার ও সাঙ্গু নদীর দৈর্ঘ্য ২৯৫ কিলোমিটার।
এই চার নদীর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে চবি অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া দৈনিক আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রামের প্রত্যেকটা নদীই এফেক্টেড। বিশেষ করে হালদা ও কর্ণফুলী। পরিবেশবান্ধব চট্টগ্রামের জন্য হালদা ও কর্ণফুলীকে রক্ষা করতে হবে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, কর্ণফুলীর দুই পাড়ে অবৈধ দখলে নিয়ে ২ হাজার ১৮১ জন দখলদার বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করেছেন। এর মধ্যে আরএস রেকর্ড মূলে কর্ণফুলী নদীর বাকলিয়া ও পূর্ব পতেঙ্গা মৌজায় সর্বমোট ২১১২ জন অবৈধ দখলদার এবং বিএস রেকর্ড মূলে বাকলিয়া, মাদারবাড়ি, গোসাইলডাঙ্গা, মনোহরখালি, ফিরিঙ্গি বাজার মৌজায় সর্বমোট ৬০ জন অবৈধ দখলদার আছেন। কর্ণফুলীর তীরে মোট ১৫৮ দশমিক ৪৫ একর ভূমিতে স্থাপনা গড়েছে। স্থানীয়ভাবে ১৫৮ একর ভূমির মূল্য দুই হাজার ৩৭০ কোটি। গত ১৬ আগস্ট এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে হাইকোর্টেও রায় হয়েছে। তবে রায়ের কপি না পাওয়ায় উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করতে পারছে না প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়া নানা কারণে এই নদীটি পড়েছে দূষণের কবলে। নদীটির দূষণ প্রসঙ্গে গত জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের টাস্কফোর্স কমিটির সভায় পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক রইছ উল আলম বলেছিলেন, কর্ণফুলী নদীর তীরে ১৩৩টি কারখানা রয়েছে যেগুলো নদীতে তরল বর্জ্য ফেলছে। এরমধ্যে ১২৩ প্রতিষ্ঠানের ইটিপি কাগজে–কলমে আছে। ১০টি প্রতিষ্ঠানে নেই।
কর্ণফুলীর মত দূষণের কবলে আছে হালদা নদীও। এছাড়া দখলসহ মনুষ্য সৃষ্ট আরো নানা প্রতিবন্ধকতা এ নদীকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দখল, ভরাট ও দূষণে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে নদীটি। বর্তমানে হালদা নদীতে ১২টির বেশি বাঁক কেটেছে স্থানীয়রা। এর মধ্যে ভাটিতে নয়টি ও উজানে তিনটি বাঁক আছে। বাঁকের কারণে হালদা নদীর দৈর্ঘ্য কমেছে ২৫ কিলোমিটার। গত ১৭ জানুয়ারি হালদা নদী পরিদর্শন শেষে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আতাহারুল ইসলাম দৈনিক আজাদীকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, হালদায় দূষণের মাত্রা বাড়ছে দিন দিন। বিভিন্ন ছড়া বা খাল কিংবা কর্ণফুলীর কারণেই এই দূষণ হচ্ছে। এখনো হালদাকে রক্ষার সময় আছে। যে রাবার ড্যাম হয়েছে তার কারণে হালদার একটি অংশ শুকানো হয়। ওই সময়ও দূষণ বাড়ে।
এদিকে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ‘বাংলার আমাজান’ খ্যাত সাঙ্গু নদীও ভরাট ও দখলদারের কবলে পড়েছে। চট্টগ্রামের আরেক ঐতিহ্যবাহী রাঙ্গুনিয়ার ইছামতি নদীও একই সমস্যায় জর্জরিত।