অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের সুনামকে পুঁজি করে অযাচিতভাবে অভিভাবকদের কাছ থেকে অনেক সুযোগ নিয়ে থাকে। ডোনেশনের নামে মোটা অঙ্কের অর্থ গ্রহণ, উন্নয়ন ফি, লাইব্রেরি ফি ইত্যাদি গ্রহণ এর উদাহরণ
বছরের শেষ দিকে শিশুদের স্কুলে ভর্তি নিয়ে অনেক অভিভাবকের মধ্যে উৎকণ্ঠা লক্ষ করা যায়। শিশুদের নানারকম ভর্তি কোচিং করানো, স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগ, দেনদরবারের প্রচেষ্টা; এমনকি অর্থকড়ি, রাজনৈতিক প্রভাব ইত্যাদি চেষ্টা-তদবিরেও অনেক অভিভাবক লিপ্ত হয়ে পড়েন। উদ্দেশ্য একটাই, ভালো স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করানো। ভালো শিক্ষা, উন্নত শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে সন্তান সুশিক্ষিত হবে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে, পরিবার-সমাজ, দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনার যোগ্য হিসেবে তৈরি হতে পারবেÑ এটাই অভিভাবকদের প্রত্যাশা। কিন্তু এ শুভ প্রত্যাশাকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে প্রাথমিক উপায় হিসেবে ভালো স্কুল নির্বাচনে অনেক অভিভাবকই ভুল করে বসেন। পরিস্থিতি তাদের অনেককে ভুল করতে বাধ্য করে। আসলে স্কুল নির্বাচনের আগে ভালো স্কুল বা ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাকে বলে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট এবং যথার্থ ধারণা থাকা দরকার। খুব সাধারণ বা সাদামাটাভাবে চিন্তা করলে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে বৈশিষ্ট্যগুলো অত্যাবশ্যক বলে মনে হয়, তাহলোÑ ১. ভালো শিক্ষক, ২. ভালো ব্যবস্থাপনা, ৩. সুবিন্যাস্ত শ্রেণিকক্ষ এবং খেলার মাঠসহ সুন্দর ক্যাম্পাস, ৪. শ্রেণিকক্ষে পর্যাপ্ত পাঠদানের ব্যবস্থা (পড়সঢ়ষবধঃব ংপযড়ড়ষরহম), ৫. উত্তম নৈতিক চরিত্র গঠন ও সামাজিকীকরণের সুযোগ, ৬. সৃজনশীলতার বিকাশ সাধনে সহায়তা করা, ৮. আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ, ৯. মাত্রাতিরিক্ত পাঠ্য বিষয়ের বদলে পর্যাপ্ত পাঠ্যক্রম, ১০. প্রত্যেক শিশুর মধ্যে সুস্থ-সুন্দর স্বপ্ন ঢুকিয়ে দেয়া এবং তা অর্জনে আত্মবিশ্বাসী করে তোলা।
প্রথমেই ভালো শিক্ষক নিয়ে আলোচনা করা যাক। ভালো শিক্ষক বলতে সেই শিক্ষকদেরই বোঝানো যেতে পারে, যারা শিক্ষকতাকে নিছক একটি পেশা বা অন্ন-বস্ত্র-ভিটামিন অর্জনের উপায় হিসেবে গ্রহণ না করে, এ মহান কাজকে একটি মিশন হিসেবে গ্রহণ করেন। এ মিশন হলো যথার্থ মানব সৃষ্টির মিশন। সৃষ্টিকুলের মধ্যে মানবশিশুই বোধ করি সর্বাপেক্ষা পরনির্ভরশীল। মানবশিশু জন্মের পর নিবিড় তত্ত্বাবধানে পর্যাপ্ত লালন-পালনের মাধ্যমে বেঁচে থাকে, বেড়ে ওঠে এবং যথার্থ শিক্ষার মাধ্যমে আদর্শ মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারে। এ আদর্শ মানুষ হতে হলে যে শিক্ষার দরকার, সেজন্য দরকার আদর্শ শিক্ষক। শিক্ষকই হবেন শিক্ষার্থীদের জন্য আদর্শ মানুষ। শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠন, স্বপ্ন দেখা, উচ্চাভিলাষ সবকিছুর পরিচালক বা তত্ত্বাবধায়ক হবেন শিক্ষক। একজন আদর্শ শিক্ষকই মানব শিশুকে সুন্দর জীবনের ধারক হওয়ার উপযোগী করে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন।
একজন শিক্ষকের পা-িত্য থাকতে হবে। এটি একটি অবশ্যিক বিষয়; কিন্তু শুধু পা-িত্য থাকলেই চলবে না। তাকে হতে হবে আদর্শ মানুষ গড়ার যোগ্য কারিগর। যে বিদ্যালয়ে এ যোগ্য কারিগর রয়েছেন, সে বিদ্যালয় ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়ার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ শর্তটি পূরণ করল। এখন কথা হলো, এ ধরনের শিক্ষককে চেনা যাবে কীভাবে? যিনি শ্রেণিকক্ষে অত্যন্ত যতেœর সঙ্গে পাঠদান করেন, বিদ্যালয়ের গ-ির মধ্য থেকেই যে শিক্ষার্থীদের পাঠ বুঝিয়ে, এমনকি শিখিয়ে দিতে পারেন, যিনি নিজের বাসায় কোচিংয়ে যেতে বলেন না, কোচিং বাণিজ্য ঘৃণা করেনÑ বাহ্যিকভাবে একজন শিক্ষকের এ গুণাবলি দেখেই তাকে আদর্শ শিক্ষক বলা যেতে পারে।
লক্ষ করলে দেখা যাবে, ছেলেমেয়েকে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করানোর জন্য অভিভাবকরা প্রবল প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন, এর অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে আদর্শ শিক্ষক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যত বড় নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তত বড় কোচিংয়ের ফাঁদ। নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সেখানে অধিকাংশ শিক্ষকই কোচিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত পাঠদানের বদলে তারা কঠোর প্রশাসনিক তৎপরতার মাধ্যমে পড়া আদায় করেন। আর সেই পড়া বা শিক্ষা আয়ত্ত করার জন্য শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের বাসায় গিয়ে কোচিং ক্লাস করে। তথাকথিত নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ভালো রেজাল্ট করার জন্য প্রায় সব বিষয়ই শিক্ষকের বাসায় গিয়ে কোচিং করতে হয়।
একজন ভালো শিক্ষক শিক্ষার্থীদের এমনভাবে পড়াতে পারেন, যাতে শিক্ষার্থীরা আনন্দের সঙ্গে পাঠ গ্রহণ করে। ভয়ভীতি, শারীরিক, মানসিক নির্যাতন করে পড়া আদায় করা কোনো ভালো শিক্ষকের কর্ম নয়। অথচ ভালো রেজাল্ট করে অথবা নানাভাবে সুনামধারী অনেক তথাকথিত উন্নত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের বকাঝকা করে; এমনকি কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ও শাস্তি প্রদান করে পড়া আদায় করা হয়ে থাকে। বাসায় টিউটর রেখে এবং স্কুল শিক্ষকদের কোচিংয়ে গিয়ে শিক্ষার্থীরা হোমওয়ার্ক রেডি করে বা পাঠ্য বিষয় শিখে থাকে। আমাদের গ্রাম-গাঁয়ে অখ্যাত অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে এ ধরনের বিড়ম্বনা নেই। শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষেই পাঠ বুঝিয়ে দেন। অনেকটা শহরাঞ্চলে যেসব নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অপেক্ষাকৃত ভালো মানের শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাচ্ছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে শিক্ষকরা অশুভ কোচিং বাণিজ্যে লিপ্ত হচ্ছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের ভালো রেজাল্ট মেকিংয়ের নেপথ্যে এ বাস্তবতা শুধু ভুক্তভোগীরাই জানেন। তথাকথিত ভালো স্কুলে সন্তান ভর্তি করে অনেক অভিভাবকই নানারকম বিড়ম্বনার শিকার।
ভালো বলে পরিচিত অনেক স্কুলে সরকারিভাবে নির্ধারিত অর্থাৎ এনসিটিবি কর্তৃক নির্ধারিত পাঠ্য বিষয়ের বাইরে অতিরিক্ত অনেক বিষয় শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেয়। এ অতিরিক্ত পাঠ্য বিষয় দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপকরা অভিভাবকদের দেখাতে চান যে, তাদের প্রতিষ্ঠান অনেক অগ্রসরমান শিক্ষা দিয়ে থাকে। অনেক অভিভাবকও এটা দ্বারা আকৃষ্ট হন। কিন্তু কোমলমতি শিশুদের পক্ষে কোন বয়সে কতটা পাঠ ধারণ করা সম্ভব হবে, তা অনেক সময় লক্ষ করা হয় না। শিশুদের খেলাধুলা, বিনোদন সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে অন্ধভাবে দিনরাত পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত রাখেন অনেক অভিভাবক। এতে বিদ্যাশিক্ষা কোমলমতি শিশুর কাছে হয়ে ওঠে অত্যন্ত কষ্টকর; এমনকি ঘৃণার বিষয়। আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা গ্রহণের বদলে তারা ঘৃণা ও ক্ষোভের সঙ্গে পুঁথির পাঠ গিলতে থাকে। শিক্ষা সংক্রান্ত এদের উচ্চাভিলাষ ও শুভ স্বপ্নের বদলে শিক্ষা থেকে নিষ্কৃতির কামনাই তাদের অন্তরে বাসা বাঁধে। পক্ষান্তরে ধারণক্ষমতার উপযোগী পাঠ শিখতে দেয়া হলে শিক্ষার্থীরা তা ভালোভাবে বুঝে শিখতে পারে এবং নিজের মতো করে সৃজনশীল কিছু ভাবতে ও করতে পারে। শিশুর সুস্থ মানসিক; এমনকি শারীরিক বিকাশের জন্য যা একান্ত জরুরি।
তথাকথিত কিছু ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মূলত মেধাবী শিক্ষার্থী ভর্তি করে এবং বিদ্যালয়ে কঠোরতা আরোপ করে শিক্ষার্থীদের ভালো রেজাল্ট করিয়ে নেয়। এজন্য অভিভাবকদের জোগান দিতে হয় বাড়তি শ্রম ও অর্থ। সন্তান নিয়ে শিক্ষকদের বাসায় বাসায় হাজিরা দিতে হয় অভিভাবকদের। গৃহশিক্ষক রাখতে হয়। এসবই করতে হয় স্কুলে সঠিকভাবে পাঠ বুঝিয়ে না দেয়ার কারণে। যেসব শিক্ষার্থী স্কুলের বাইরে কোচিং করতে পারছে না, তারা স্কুলে ভালো ফল করতে পারছে না। শিক্ষকদের ভর্ৎসনার শিকার হচ্ছে। অনেককে মন্দ ফলের জন্য স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়। অনেক নামিদামি স্কুল রয়েছে, যেখানে প্রতি বছর লাখ লাখ টাকার ভর্তি বাণিজ্য চলে। ওইসব স্কুলের প্রতি ক্লাসে প্রতি বছর সন্তোষজনক ফল না করার দায়ে কিছু শিশুকে স্কুল থেকে ছাঁটাই করা হয়। আর ওই আসনগুলো অনেক ক্ষেত্রেই অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করা হয়। অনেক স্কুলের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরির পদ্ধতি, ফল নির্ধারণ বা গ্রেডিংয়ের এমন কিছু অভিনব নিয়ম রয়েছে, যে নিয়মের অর্গল পেরিয়ে যথাযোগ্য ফল করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। তবে স্কুল শিক্ষকদের ব্যক্তিগত কোচিংয়ে হাজিরা দিলে বা তাদের উপঢৌকন দিয়ে খুশি করতে পারলে ভালো ফল নিশ্চিত করা যায়।
অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের সুনামকে পুঁজি করে অযাচিতভাবে অভিভাবকদের কাছ থেকে অনেক সুযোগ নিয়ে থাকে। ডোনেশনের নামে মোটা অঙ্কের অর্থ গ্রহণ, উন্নয়ন ফি, লাইব্রেরি ফি ইত্যাদি গ্রহণ এর উদাহরণ। তবে এতসব অজুহাতে অর্থ গ্রহণ করা হলেও এসব অর্থ কোন খাতে কীভাবে কতটুকু ব্যয় হচ্ছে, তার হিসাব অভিভাবকদের দেয়া তো দূরের কথা, অনেক ক্ষেত্রে ওই প্রতিষ্ঠানই এসব খাত আলাদা করে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন করে না। সরকার ভর্তি ফিসহ ভর্তির নিয়মাবলি নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু খুব কম স্কুল আছে, এসব নিয়ম মান্য করে। অথবা কাগজপত্রে নিয়ম মান্য করার দলিল থাকলেও কার্যত তা মান্য করা হয় না। ভালো প্রতিষ্ঠানে সন্তান পড়ানোর সুযোগে সন্তুষ্ট হয়ে অভিভাবকরাও এসব বিষয়ে সাধারণত কোনো নজরদারি করেন না।
স্কুলে ভর্তির সময় এলে শিক্ষার্থীদের ওপর অনেক চাপ থাকে। তাদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হয়। এ যুদ্ধ লেখাপড়ার সুযোগ প্রাপ্তির জন্য। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে শিক্ষা লাভ শিশুর অধিকার। এটি কোনো অনুগ্রহ লাভ, ক্রয়যোগ্য বা দখলযোগ্য বিষয় নয় যে, তা যুদ্ধ করে এবং অর্থ দিয়ে লাভ করতে হবে। তার চেয়ে বড় কথা হলো, কোথায় পড়ার জন্য শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবক যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে, তা তাদের খতিয়ে দেখতে হবে। শুধু বাহ্যিক রেজাল্ট ভালো দেখেই কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতি অন্ধভাবে আকৃষ্ট হওয়া সঙ্গত নয়। অন্যদিকে ভর্তি নিয়ে বাণিজ্য বন্ধ করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া দরকার।