ডেইলি কক্সবাজার রিপোর্ট :
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের অধিনে কক্সবাজার শহরতলীর কলাতলীতে ‘ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন এন্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেস’ (ইনমাস) কার্যক্রম শুরু হয়েছে ২০১৩ সালের জুন মাসে। পরমানু শক্তিকে কাজে লাগিয়ে রোগ নির্ণয় ও আধুনিক চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা আছে। আছে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এবং দক্ষ জনশক্তিও। তবে সেই অনুপাতে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানটিতে রোগীর দেখা মেলে না। ফলে প্রতি মাসে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন এবং প্রতিষ্ঠান পরিচালনার আনুষাঙ্গিক খরচ বাবদ কয়েক লাখ টাকা গচ্ছা দিতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর সরকারি এই চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে রোগী না আসার অন্যতম প্রধান কারণ হলো, জেলার অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থেকে প্রত্যাশামতো রোগী রেফার করা হয়না। চিকিৎসকরা বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে রোগী রেফার করে নির্দিষ্ট হারে কমিশন পান। ইনমাস-এ ওই কমিশন দেওয়া হয়না বলে তারা রোগীদের রেফার করেন না। আরেকটি কারণ হলো, চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে জেলার সাধারণ মানুষের মাঝে এখনো স্বচ্ছ ধারনা তৈরী হয়নি। অনেকেই জানেন না,
কক্সবাজাওে এমন একটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার ফলে বঞ্চিত হচ্ছে আধুনিক স্বাস্থ্য সেবা থেকে। যেখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা আধুনিক আবার সেবা গ্রহনের খরচও তুলনামূলকভাবে অনেক কম।
সরকারী প্রতিষ্ঠান হওয়ায় প্রচারনা না থাকা এবং কিছু অসাধু প্যাথলজি ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারনেই এই অবস্থা বলে মনে করছেন অনেকে।
পরমাণু চিকিৎসা এবং আল্ট্রাসাউন্ড কেন্দ্র কক্সবাজার এর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. মোস্তফা শামীম আহসান বলেন, পরমাণু চিকিৎসা একটি আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি। উন্নত বিশ্বে এ চিকিৎসা পদ্ধতির বহুল প্রচলন এবং সর্বজন স্বীকৃত। দেশের ১৫তম চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে কক্সবাজারে এটি স্থাপন হয়েছে।
পরমাণু চিকিসক ডা. মোস্তফা শামীম আহসান আরো জানান, অত্যাধুনিক মেশিনের সাহায্যে এ চিকিৎসা করা হয়। এ চিকিৎসা পদ্ধতি সহজ, নিরাপদ ও সীমিত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পন্ন। মূলত পদার্থের পরমাণুর কেন্দ্রে অবস্থিত নিউক্লিয়াসের অতি শক্তিশালী রশ্মিকে কাজে লাগিয়ে এ চিকিৎসা করা হয়। তিনি জানান, পরমাণু এ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা করা হয়।
কক্সবাজার শহরের কলাতলীতে অবস্থিত ‘ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন এন্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেস’ এ গিয়ে দেখা যায়, চারপাশে পরিপাটি বাগান আর পরিষ্কার-পরিছন্নতা নিয়ে সুন্দর পরিবেশ বিরাজ করছে ওই ইনস্টিটিউটে। ওখানে রয়েছে রোগ নির্ণয়ের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি, রোগীদের সেবা নিশ্চিত করনে নানা ব্যবস্থাপনা, পুরো ভবনে ওয়াইফাই (ইন্টারনেট), এসি সমৃদ্ধ রোগী ও অভিভাবকদের বসার স্থান। সর্বপরি পুরো পরিবেশটাই স্বাস্থ্য-সম্মত এবং উন্নত।
ওই ইনস্টিটিউটে সাধারণত দুই প্রকার চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। তা হল রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা সেবা। রোগ নির্ণয়ের মধ্যে রয়েছে, আল্ট্রাসনোগ্রাম, কালার ডপলার, সিন্টিগ্রাফী (রেনোগ্রাম/জি.এফ.আর, বোন স্ক্যান, ব্রেইন স্ক্যান, লিভার স্ক্যান, হাইডা স্ক্যান, থাইরয়েড গ্রন্থির বোগ নির্ণয় (হরমোন পরীক্ষা, থাইরয়েড স্ক্যান, থাইরয়েড আপটেক) আর চিকিৎসা সেবার মধ্যে রয়েছে, থাইরোটক্সিকোসিস (রেডিও আয়োডিন দ্বারা টক্সিক অবস্থাকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনা) ও থাইরয়েড ক্যান্সার রেডিও আয়োডিন ক্যাপসুলের সাহায্যে থাইরয়েড ক্যান্সারের চিকিৎসা প্রদান।
প্রশাসনিক শাখা সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানটিতে একজন মূখ্য চিকিৎসা কর্মকর্তা, একজন মেডিক্যাল অফিসার, একজন সায়েন্টিফিক অফিসার, একজন সায়েন্টিফিক এ্যাসিসটেন্ট, দুইজন ল্যাব এ্যাসিসটেন্ট, একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা, একজন একাউন্টেন্ট, একজন অফিস সহকারি, একজন পিয়ন, ২ জন আয়া, ২ জন পরিচ্ছন্ন কর্মী এবং ৩ জন নিরাপত্তা রক্ষী কর্মরত আছেন। তারা বেতন পাচ্ছেন দৈনিক ভিত্তিতে।
শহরের বড় বাজারস্থ জান্নাতুল ফেরদৌসী জানান, হরমোন পরীক্ষা করতে গিয়ে তিনি ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন এন্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেস প্রতিষ্ঠানটি চিনতে পারেন। তিনি সরকারী ওই ইনস্টিটিউটের পরিবেশ দেখে খুবই মুগ্ধ। তিনি ওই পরিক্ষা আগেও করেছিলেন চট্টগ্রাম থেকে বেশি দামে। অনেক কম দামে তিনি হরমোন পরিক্ষা করেছেন ইনমাস থেকে। তিনি জানান, এই প্রতিষ্ঠানে হরমোন ছাড়াও নানা জটিল রোগের পরিক্ষা করা হয়। কিন্তু ওখানে তেমন কোন রোগী দেখা যায়নি।
কক্সবাজার ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন এন্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেস এর ল্যাব সহকারি আকিব জাবেদ বলেন, ‘জেলার বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে যেখানে হরমোন পরীক্ষার জন্য প্রায় ৩ হাজার টাকা খরচ হয় সেখানে আমরা ওইসব পরীক্ষা করছি এক হাজার টাকারও কম খরচে। ইউএসজি অব কেইউবি, প্রোস্ট, এমসিসি, পিভিআর, ইউএসজি অব প্রেগনেন্সি প্রোপাইল, ইউএসজি অব হোল এ্যাবডোমেন, এইচআরইউস অব ব্রেস্ট, এইচআরইউএস অব থাইরয়েড প্রভৃতি পরীক্ষা অন্য বেসরকারি হাসপাতালে এক হাজার টাকার উপরে নেওয়া হয়, কিন্তু এখানে এসব পরীক্ষা ৩০০ টাকার মধ্যে করা যাচ্ছে। ইউএসজি অব হোল এ্যাবডোমেন পরীক্ষার জন্য নেওয়া হয় ৪৫০ টাকা। এভাবে সব পরীক্ষাই আমরা অত্যন্ত কম খরচে করছি। এখানে দু’টি করে ইউএসজি (আল্টাসনোগ্রাম) মেশিন, স্পেক্ট (গামা ক্যামেরা) মেশিন ও আর.আই.এ কাউন্টার মেশিনের মতো আধুনি যন্ত্রপাতি আছে। কিন্তু প্রত্যাশামতো রোগী আসছে না।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানান, বর্তমানে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় ভাল’র পাশাপাশি বানিজ্যিক চিন্তাধারা চলে এসেছে। যার প্রেক্ষিতে কিছু অসাধু চিকিৎসক চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ঠকায়। তারা কমিশনের লোভে সরকারী প্রতিষ্ঠান বাদ দিয়ে তাদের পছন্দের প্যাথলজি দেখিয়ে দিচ্ছে। ওসব প্যথলজিতে গিয়ে রোগ নির্ণয় পরিক্ষা প্রতি তাদের দিতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। আবার অনেক সময় সঠিক রিপোর্টও পাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে জনগনকে সচেতন হতে হবে। আর অসাধু চিকিৎসকদের মন মানষিকতাও বদলাতে হবে।