রাজধানীর অদূরে রূপগঞ্জের পূর্বাচল সিটি ও উত্তরার দিয়াবাড়ির খালে পানির নিচ থেকে গত এক বছরের ব্যবধানে বিপুল পরিমাণ অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের চালান উদ্ধারের পর নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এসব অস্ত্র মজুদে নেপথ্যের গডফাদার ও ষড়যন্ত্রকারীদের যোগসূত্র এখনো বের করা সম্ভব হয়নি। তবে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে এসব অস্ত্র দেশে ঢোকে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।
জানা গেছে, দেশে অবৈধ অস্ত্রের চালান অহরহই ঢুকছে। বাড়ছে অস্ত্রের মজুদ। শুধু সীমান্ত পথেই নয়, বৈধ অস্ত্রের আড়ালেও আনা হচ্ছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। এসবের মধ্যে ক্ষুদ্রাস্ত্রই বেশি। সীমান্ত এলাকাসহ রাজধানী ও এর আশপাশ এলাকায় ‘কঠোর’ নিরাপত্তার মধ্যে কীভাবে অস্ত্রের চালান আসছে, এর কোনো সদুত্তর নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। এতে তাদের নজরদারি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তা ভেদ করে কীভাবে এত অস্ত্র দেশে ঢুকছে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারণ সীমান্ত পেরিয়ে এভাবে অস্ত্রের চালান ঢুকতে থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এত অস্ত্র-গোলাবারুদ কোথা থেকে, কীভাবে আসছে, এর সঙ্গে কারা জড়িত, এসব প্রশ্নের কোনো কূলকিনারাও করতে পারছে না নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, অবৈধ অস্ত্রের পেছনে আন্তর্জাতিক মাফিয়া ও চোরাচালানিদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক কাজ করছে। তারা বাংলাদেশকে অস্ত্র ব্যবসার রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। তবে এ সুযোগে এসব অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদের ক্ষুদ্র একটি অংশ সহজেই বাংলাদেশের জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের হাতে চলে যাচ্ছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, দিয়াবাড়ি ও পূর্বাচল থেকে যে বিপুল অস্ত্র জব্দ হলো এর পেছনে কারা জড়িত তদন্তের মাধ্যমে তা বের করা হোক। এত বড় বড় অস্ত্রের মজুদদাররা যে দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে তা স্পষ্ট। সীমান্ত পথেই অস্ত্র ঢুকছে, সে বিষয়ে বিজিবিকে আরো তৎপর হতে হবে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তায় সংশ্লিষ্ট বাহিনীকে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে হবে।
গত বছরের ১৮, ১৯ ও ২৫ জুন রাজধানীর তুরাগ থানার মিরপুর-আশুলিয়া বেড়িবাঁধ সংলগ্ন দিয়াবাড়ি খাল থেকে তিন দফায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও বিস্ফোরকের সন্ধান পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বস্তাভর্তি এসব অস্ত্র-গোলাবারুদ খালের পানিতে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। এ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ সংশ্লিষ্টরা। এই বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধারের সপ্তাহ না পেরুতেই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁর সেই জঙ্গি হামলায় প্রাণ হারান দেশি-বিদেশি ২২ জন। কমান্ডো অভিযানে পাঁচ জঙ্গিও নিহত হয়।
এদিকে, উত্তরার দিয়াবাড়ি খাল থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদ জব্দের ঠিক এক বছর পর গত ১ জুন রাতে রাজধানীর অদূরে রূপগঞ্জের পূর্বাচলের কাছাকাছি আরো দুটি খাল থেকেও অস্ত্র-গোলাবারুদের সন্ধান মেলে। দুটি ঘটনায় পাওয়া অস্ত্রের চালানের মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতে, দুটি চালান একই গোষ্ঠীর। যদিও এখন পর্যন্ত দুটি ঘটনার কোনোটিরই রহস্য ভেদ করতে পারেনি তারা।
যে মুহূর্তে রাজধানীসহ দেশব্যাপী জঙ্গিবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান চলছিল, ঠিক তখন এত বড় অস্ত্রের চালান উদ্ধারের ঘটনা জঙ্গিবিরোধী অভিযানকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়। যদিও গত এক বছরে জঙ্গিবিরোধী প্রায় ২০টি অভিযানে ৫৭ জন জঙ্গি নিহত ও অর্ধশত জঙ্গিকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সেসব অভিযান থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদও জব্দ করা হয়।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, অস্ত্রের বড় বড় চালান দেশে এর আগেও এসেছে। আমরা চেষ্টা করছি তা বন্ধ করতে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যাপক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। দিয়াবাড়ি ও পূর্বাচল সিটির লেক থেকে অস্ত্রের চালানটি উদ্ধার তারই প্রমাণ। সন্ত্রাসী চক্রের হাতে যাওয়ার আগেই অস্ত্রের চালানটি ধরা পড়েছে। এতেই প্রমাণ হয় র্যাব-পুলিশ খুবই তৎপর। তিনি আরো বলেন, সরকার জঙ্গি দমনে যেমন সফলতা অর্জন করেছে, তেমনি অস্ত্র উদ্ধার অভিযানেও সফল।
একই বিষয়ে গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন বলেন, বিভিন্ন এলাকার সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র আসছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকেই বেশির ভাগ অস্ত্র বাংলাদেশে ঢোকে। তারপর সেগুলো পৌঁছে যায় সন্ত্রাসীদের কাছে। এসব অস্ত্র ও অস্ত্রধারী ধরতে ডিবির একাধিক টিম মাঠে কাজ করছে।
এদিকে, গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ ও র্যাবের হাতে সম্প্রতি আগ্নেয়াস্ত্র ধরা পড়ার ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশের ৪৮টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিনই অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের চালান ঢুকছে। সবচেয়ে বেশি আসছে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে। ভারতে তৈরি ৭.৬৫ পিস্তল বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায় কিনছে চোরাকারবারিরা। সেই অস্ত্র বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকায়। আর ৯ এমএম পিস্তল সীমান্তে বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকায়। সেই অস্ত্র ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে অন্য জেলায় পৌঁছানোর পর। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে এই অস্ত্র বেশি ঢুকছে। ফল ও সবজির ট্রাক এবং ট্রেনে করে এসব অস্ত্র পালাক্রমে হাতবদল হয়ে বিভিন্ন জেলায় পৌঁছে যাচ্ছে। এগুলোর বেশির ভাগই আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভোটের মাঠে ব্যবহারের জন্য আসছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অবৈধ অস্ত্র, বিস্ফোরক ও গুলি উদ্ধারের ঘটনাও বেড়েছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এই ছয় মাসে শুধু রাজধানীতেই উদ্ধার হয়েছে ২৩১টি আগ্নেয়াস্ত্র। একই সময়ে অস্ত্র-সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ১৯৪টি। গ্রেফতার হয়েছে ৪১৫ জন।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সারা দেশে অস্ত্র ঢুকছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, যশোরের বেনাপোল ও সাতক্ষীরা হয়ে। কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্ত পথেও চোরাই অস্ত্র আসছে। কিছু ধরা পড়লেও অধিকাংশই রয়ে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। গত বছরের ৩১ অক্টোবর ভারতের খায়রুল ইসলাম ম-ল ১০টি আগ্নেয়াস্ত্রসহ গ্রেফতার হন। তার বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনায় হলেও কয়েক বছর ধরে তিনি বাংলাদেশেই থাকছেন। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে ম-ল জানান, প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। প্রতি মাসে অন্তত ১০টি অস্ত্র ঢাকায় পাঠান। এসব অস্ত্র তিনি ঢাকায় এনে ৮০ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। অস্ত্র চোরাচালানে তিনি মূলত বেনাপোল সীমান্ত ব্যবহার করতেন। সীমান্ত এলাকায় তার ২০-২২ জন সহযোগী রয়েছে।
বৈধ দোকানে অবৈধ অস্ত্রের কেনাবেচা : অনুমোদিত অস্ত্রের দোকান থেকেও অবৈধভাবে বিদেশি অস্ত্র বিক্রি করা হচ্ছে। আবার বৈধ অস্ত্রের আড়ালেও অবৈধ অস্ত্রের চালান আমদানি করছে ব্যবসায়ীরা। সম্প্রতি পল্টনের ইমরান আর্মস কোম্পানির এক চালানে অবৈধভাবে আনা কমপক্ষে ৪৭টি অস্ত্র জব্দ করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর (সিআইআইডি)। আমদানির পর বিশেষ প্রক্রিয়ায় এসব অস্ত্রের গায়ের সিরিয়াল নম্বর তুলে ফেলে বিক্রি করা হয়। কখনো অস্ত্র ধরা পড়লে সিরিয়াল নম্বর দেখে আমদানি প্রতিষ্ঠানের নাম-পরিচয় যাতে জানা না যায়, সে জন্যই এ সতর্কতা। যথেষ্ট প্রমাণ না থাকায় এসব দোকানে অভিযান চালাতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আবার সীমান্তপথ দিয়ে আসা অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহের পাশাপাশি ভুয়া লাইসেন্স দিয়েও অস্ত্র বিকিকিনি চলছে।
দেশের ইতিহাসে বড় অস্ত্রের চালান : ২০১৪ সালে হবিগঞ্জের সাতছড়ি উদ্যানে, ২০১৫ সালে চট্টগ্রামের বাঁশখালী, তারপর খাগড়াছড়ি এবং ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শেরপুরের দুর্গম পাহাড়েও একই রকম বড় অস্ত্রের ভা-ার পাওয়া যায়। এ পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের ধরন একই রকম এবং এর প্রায় সবই এখনো ব্যবহারের উপযোগী। এ পর্যন্ত পাওয়া অস্ত্র দিয়ে সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়নকে সজ্জিত করা সম্ভব। আর যা এখনো পাওয়া যায়নি তা নিয়ে শঙ্কা তো রয়েই যায়। আসামের সশস্ত্র বিদ্রোহীদের জন্য আনা ১০ ট্রাক অস্ত্রের চোরাচালান ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রামে ধরা পড়ে। ওই অস্ত্রের চালানের সঙ্গে তৎকালীন সরকারের মন্ত্রী ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানরা জড়িত ছিলেন। আদালতে তা প্রমাণের পর তাদের সাজাও হয়েছে।
২০১১ সালের ৮ আগস্ট ভারতের ইংরেজি দৈনিক হিন্দুস্তান টাইমস-এ এক সাক্ষাৎকারে উলফাপ্রধান অরবিন্দ রাজখোয়ার বলেন, পাকিস্তানের উগ্রপন্থি একটি অংশ উলফাকে অস্ত্র সরবরাহ করত। আর সেসব অস্ত্র বাংলাদেশ হয়ে আসামে ঢুকত। রাজখোয়া বলেন, অস্ত্রের বড় একটি চালান ২০০৪ সালে চট্টগ্রামে ধরা পড়লেও অস্ত্র আনার ক্ষেত্রে তারা বেশির ভাগ সময়ই সফল হয়েছেন।