আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে ৩০টি পুলিশ ফাঁড়ি ও একটি সেনা ক্যাম্পে হামলা চালায়। মিয়ানমারের সরকারি সূত্র বলছে, আরসা একটি রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী এবং ওই হামলায় ১০ পুলিশ কর্মকর্তা, ১ জন সেনা ও ১ জন অভিবাসী কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। নিহত হয়েছেন ৭৭ জন ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এখন বাংলাদেশের সীমান্তে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষের ঢল নেমেছে। পাওয়া যাচ্ছে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর চালানো নির্যাতনের খবর।
সংবাদ সংস্থা আল জাজিরার সঙ্গে কথা বলেছেন রাখাইন রাজ্যে বাস করা রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি। তাঁর বয়স ২৪ বছর। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের অবস্থা, তাঁরা এত দিন কীভাবে কাটিয়েছেন এবং দেশটির বর্তমান সরকারের ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাশা—এসব বিষয় নিয়ে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। তবে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁর পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য ওই ব্যক্তির কথাগুলো তুলে ধরা হলো—
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু—সারাটা জীবন ধরে, প্রায় ২৪টি বছর, আমি এই রাজ্যে খোলা আকাশের নিচে এক কারাগারে বন্দী হয়ে আছি। আমি মিয়ানমারে জন্মগ্রহণ করেছি। মা-বাবার সূত্রে এই দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার কথা আমার। কিন্তু মায়ের গর্ভে আসার আগেই আমার নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের কারণে আমার চলাফেরা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রবেশাধিকার এবং পুরো ক্যারিয়ারই ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় আছে।
আমি সরকারি কোনো পদে কাজ করতে পারি না। আমি নিষিদ্ধ। উচ্চশিক্ষা লাভের অধিকার নেই। দেশের রাজধানী ইয়াঙ্গুনে ঢোকার ক্ষেত্রে আমাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি রাখাইন রাজ্য ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চাইলেও বাধা দেওয়া হয়। বৈষম্যের সবচেয়ে খারাপ দৃষ্টান্তের মুখোমুখি আমি। কারণ, আমি একজন রোহিঙ্গা—রোহিঙ্গা মুসলিম।
বছরের পর বছর ধরে আমার জনগোষ্ঠীর মানুষেরা ন্যূনতম মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই তাঁদের কাউকে না কাউকে হত্যা করা হয়েছে। সবার চোখের সামনে গুলি করে হত্যা এবং জোর করে ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে আমাদের উদ্বাস্তু করা হয়েছে। চোখের সামনে আমাদের ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছে। একটি নিষ্ঠুর রাষ্ট্রের অপরাধের শিকার আমরা।
আমাদের অবস্থা বোঝানোর জন্য একটি উপমা দিই। ধরুন, একটি ইঁদুরকে একটি ক্ষুধার্ত বিড়ালের সঙ্গে একই খাঁচায় রাখা হলো। এই দেশে রোহিঙ্গা হয়ে আমরা এভাবেই আছি। আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় হলো দৌড়ানো। অথবা কেউ যদি আমাদের বাঁচতে সাহায্য করে।
আমরা যাঁরা এখনো মিয়ানমারে টিকে আছি, এখানে রাখাইন সম্প্রদায় থেকে তাঁদের পৃথক রাখতে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে প্রচারণা চালানো হয়। আমাদের ‘কালার’ নামে ডাকা হয়। এটি অপমানসূচক নাম। সাধারণত মুসলিমদের বিরুদ্ধেই এটি ব্যবহার করা হয়। শিশু বা বৃদ্ধ, কেউই এখানে নিপীড়নের হাত থেকে রক্ষা পায় না। স্কুল ও হাসপাতালে আমরা বৈষম্যের শিকার হই।
আমাদের যেকোনো মূল্যে বর্জন করার জন্য প্রচারণা চালায় বৌদ্ধরা। তারা বলে, ‘শুধু বৌদ্ধদের কাছ থেকে জিনিস কিনুন। আপনি যদি বৌদ্ধদের একটি পয়সা দেন, তবে তারা প্যাগোডা বানাবে। আর মুসলিমদের দিলে, তারা মসজিদ বানাবে।’ এ ধরনের মন্তব্য এখানে প্রথাগত আচরণে পরিণত হয়েছে এবং এটি বৌদ্ধ চরমপন্থীদের আমাদের ওপর হামলা চালাতে উৎসাহ দেয়।
২০১৫ সালে যখন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চি ভোটে জিতে ক্ষমতায় এলেন, পরিবর্তন আসবে ভেবে তখন আশাবাদী হয়েছিলাম আমরা। আমরা আত্মবিশ্বাসী ছিলাম এই ভেবে যে এই নারী গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে আমাদের ওপর নিপীড়নের অবসান ঘটাবেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এ ব্যাপারে তাঁর নীরবতা সহিংসতা আরও উসকে দিয়েছে। সবশেষে তিনি আমাদের নিরাশ করেছেন। আমাদের আশার শেষ প্রদীপটিই আমাদের নিরাশ করেছে।
২০১২ সালে এক সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা মুসলিমকে হত্যা করা হয়। প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষকে দেশের ভেতরেই উদ্বাস্তু করা হয়। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে ২০১৬ সালে। গত অক্টোবরের এই সহিংসতা আরসা নামের একটি ছোট সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থানে ভূমিকা রেখেছে।
এখন আমাদের বোন ও মায়েরা ধানখেতে শিশুর জন্ম দিতে বাধ্য হচ্ছেন। পালাতে থাকা শিশুদের ওপরও গুলি চালানো হচ্ছে এবং নদীর পানিতে ভাসছে নারীদের মৃতদেহ। এটি সম-অধিকারের দৃষ্টান্ত নয়।
আমরা নিশ্চিহ্নের মুখোমুখি। যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের পাশে না দাঁড়ায়, তবে বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত মানুষ হিসেবে আমরা গণহত্যার শিকার হব। আর আপনারা তার সাক্ষী হবেন।