রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযান বন্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অবরোধ ও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। তারা বলেছে, নিরাপত্তা পরিষদের উচিত রাখাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী সেনা কর্মকর্তাসহ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা এবং তাদের সম্পদ জব্দ করা।
এদিকে রাখাইনে নৃশংসতা শুরুর প্রায় তিন সপ্তাহ পর প্রথমবারের মতো এ বিষয়ে জাতির উদ্দেশ্য ভাষণ দিতে যাচ্ছেন মিয়ানমারের নেত্রী ও স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুচি। তার সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তে এই ভাষণ দিতে যাচ্ছেন সুচি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সুচি এই ভাষণে তার সরকারের অবস্থান তুলে ধরবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর অবরোধ আরোপ আহ্বান জানিয়ে এইচআরডব্লিউ বরিবার এক বিবৃতিতে বলেছে, গত ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যের কয়েকটি পুলিশ পোস্টে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর থেকেই সেনারা সেখানে অভিযানের নামে গণঅগ্নিসংযোগ, হত্যা, লুটতরাজ চালাচ্ছে। সেনারা শত শত গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, প্রাণ বাঁচাতে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে বিশ্ব নেতারা জাড়ো হচ্ছেন। তাদের উচিত রোহিঙ্গা সংকটকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং রাখাইনে চলমান নৃশংসতার নিন্দা জানানো। একইসঙ্গে উচিত অসহায় মানুষের কাছে মানবিক সহায়তা পৌঁছতে বাধা দেওয়ায় মিয়ানমার সরকারের নিন্দা জানানো।
সংগঠনটি নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছে, সদস্য দেশগুলোর উচিত রাখাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য মিয়ানমারের ওপর ‘টার্গেটেড’ অবরোধ আরোপ করা। দায়ী সেনা কর্মকর্তা ও সদস্য-সহ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এবং তাদের সম্পদ জব্দ করা জরুরি। একইসঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সহযোগিতা নিষিদ্ধ করা এবং গুরুত্বপূর্ণ সেনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন বন্ধ করতে পদক্ষেপ নেওয়া। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক অ্যাডভোকেসি পরিচালক জন সিফটন বলেছেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন অভিযান চালাচ্ছে মিয়ানমারের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী। সময় এসেছে সেনাদের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার। যাতে মিয়ানমারের জেনারেলরা বিষয়টিকে আর উপেক্ষা না করে।
এইচআরডব্লিউ বলেছে, অসহায় মানুষের কাছে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য ত্রাণ সংস্থাগুলোকে যাওয়ার অনুমতি দিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানো উচিত নিরাপত্তা পরিষদের। একইসঙ্গে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনকে নৃশংসতা তদন্তের অনুমোদন দিতে এবং বাস্তুচ্যুত মানুষের নিরাপদে ঘরে ফেরা নিশ্চিত করতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি দাবি জানানো উচিত।
এক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সদস্যদের প্রতিক্রিয়া জানতে উন্মুক্ত আলোচনার আয়োজন করতে পারে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। রোহিঙ্গা সংকটের ব্যাপকতা তুলে ধরতে ওই সভায় জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেসকে আমন্ত্রণ জানানো উচিত তাদের। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা সংকটকে জাতি নির্মূল হিসেবে আখ্যায়িত করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার। নিরাপত্তা পরিষদের উচিত যারা বর্বর নৃশংসতা চালিয়েছে তাদেরকে দায়ী করে বিচারের আওতায় আনা, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের বিষয়টি আলোচনায় তোলা।
বিবৃতিতে এইচআরডব্লিউ বলেছে, রোহিঙ্গাদের মানবিক সংকট ও মানবাধিকার পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পদক্ষেপের দিকে তাকিয়ে থেকে সময় নষ্ট করা উচিত নয় উদ্বিগ্ন দেশগুলোর। তাদের উচিত নৃশংসতার জন্য সেনাবাহিনীর দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা, তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা, সব রকম সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি, সহায়তা এবং সহযোগিতা বন্ধ করা। বিশেষ করে কমান্ডার ইন চিফ সিনিয়র জেনারেল মিন অং হেইংসহ মিয়ানমারের জ্যেষ্ঠ নেতৃত্বকে যুক্তরাষ্ট্রের স্পেশাল ডিজাইনেটেড ন্যাশনালস (এসডিএন) তালিকাভুক্ত করা। এই তালিকায় থাকা ব্যক্তিদেরকে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানে আর্থিক সুবিধা দেওয়া হয় না। তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না এবং তাদের সম্পদ জব্দ করা হয়। একই রকম অর্থনৈতিক ও ভ্রমণ বিষয়ক অবরোধ আরোপ করা উচিত ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও এর সদস্য দেশগুলোরও। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বিদ্যমান ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার মেয়াদও বাড়ানো উচিত। একইসঙ্গে সব রকম সামরিক সহায়তাও বন্ধ করা উচিত। জাপান, নরওয়ে, দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর একই রকম পদক্ষেপ নেয়া উচিত। জন সিফটন বলেছেন, যদি সেনারা প্রকৃত আর্থিক দুরবস্থার হুমকিতে পড়ে তবেই তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বানে সাড়া দেবে। যারা জাতিগত নির্মূলযজ্ঞে লিপ্ত তাদের ওপর প্রভাব পড়বে।
বিবৃতিতে সংগঠনটি আরো বলেছে, স্যাটেলাইটে পাওয়া বেশ কিছু ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২২০টি রোহিঙ্গা গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী লুটপাট চালাচ্ছে, বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছে। অন্যদিকে মিয়ানমার সরকারের দাবি, আরসা যোদ্ধারা ও রোহিঙ্গা গ্রামবাসী এসব অগ্নিসংযোগের জন্য দায়ী। তবে এর পক্ষে তারা কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি। যদি আরসার কোনো কমান্ডার বিশ্বাসযোগ্য কোনো নৃশংসতা ঘটিয়ে থাকে এবং তা প্রমাণ হয় তাহলে তাদেরকেও অবরোধের আওতায় আনা উচিত।